Source LINK
নিচে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আসছেঃ ঐতিহাসিক সেই প্রাচীর নির্মাণ যুল কারনাইনের আলোচনা করতে গিয়ে আল্লাহ পাক বলেন- “আবার সে পথ চলতে লাগল। অবশেষে যখন সে দুই পর্বত প্রাচীরের মধ্যস্থলে পৌঁছল, তখন সেখানে এক জাতিকে পেল, যারা তাঁর কথা একেবারেই বুঝতে পারছিল না। তারা বললঃ হে যুলকারনাইন! ইয়াজূজ ও মাজূজ দেশে অশান্তি সৃষ্টি করেছে। আপনি বললে আমরা আপনার জন্যে কিছু কর ধার্য করব এই শর্তে যে, আপনি আমাদের ও তাদের মধ্যে একটি প্রাচীর নির্মাণ করে দেবেন। সে বললঃ আমার পালনকর্তা আমাকে যে সামর্থ দিয়েছেন, তাই যথেষ্ট। অতএব, তোমরা আমাকে শ্রম দিয়ে সাহায্য কর। আমি তোমাদের ও তাদের মধ্যে একটি সুদৃঢ় প্রাচীর নির্মাণ করে দেব। তোমরা আমাকে লোহার পাত এনে দাও। অবশেষে যখন পাহাড়ের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান পূর্ণ হয়ে গেল, তখন সে বললঃ তোমরা হাঁপরে দম দিতে থাক। অবশেষে যখন তা আগুনে পরিণত হল, তখন সে বললঃ তোমরা গলিত তামা নিয়ে এসো, আমি তা এর উপরে ঢেলে দেই। অতঃপর ইয়াজূজ ও মাজূজ তার উপরে আরোহণ করতে পারল না এবং তা ভেদ করতে-ও সক্ষম হল না।” (সূরা কাহফ ৯২-৯৭)
বংশধারাঃ
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, তারা হচ্ছে আদম সন্তানের-ই এক সম্প্রদায়। হাফেয ইবনে হাজার রহ.এর মতে- তারা নূহ আ.-এর পুত্র ইয়াফিছের পরবর্তী বংশধর। ইমরান বিন হুছাইন রা. থেকে বর্ণিত, কোন এক ভ্রমণে আমরা নবীজী সাথে ছিলাম। সাথীগণ বাহন নিয়ে এদিক-সেদিক ছড়িয়ে পড়ল। নবীজী উচ্চকণ্ঠে পাঠ করলেন- “হে লোক সকল! তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর। নিশ্চয় কেয়ামতের প্রকম্পন একটি ভয়ংকর ব্যাপার। যেদিন তোমরা তা প্রত্যক্ষ করবে, সেদিন প্রত্যেক স্তন্যধাত্রী তার দুধের শিশুকে ভুলে যাবে এবং প্রত্যেক গর্ভবতী তার গর্ভপাত করবে এবং মানুষকে তুমি দেখবে মাতাল; অথচ তারা মাতাল নয় বস্তুতঃ আল্লাহর আযাব বড় কঠিন।” (সূরা হাজ্ব ১-২)
নবীজীর উচ্চবাক্য শুনে সাহাবাগণ একত্রিত হতে লাগলেন, সবাই জড়ো হলে বলতে লাগলেন- “তোমরা কি জান- আজ কোন দিবস? আজ হচ্ছে সেই দিবস, যে দিবসে আদমকে লক্ষ্য করে আল্লাহ বললেনঃ জাহান্নামের উৎক্ষেপণ বের কর! আদম বলবেঃ জাহান্নামের উৎক্ষেপণ কি হে আল্লাহ..!? আল্লাহ বলবেন- প্রতি হাজারে নয়শ নিরানব্বই জন জাহান্নামে আর একজন শুধু জান্নাতে!! নবীজীর কথা শুনে সাহাবাদের চেহারায় ভীতির ছাপ ফুটে উঠল। তা দেখে নবীজী বলতে লাগলেন- আমল করে যাও! সুসংবাদ গ্রহণ কর! সেদি তোমাদের সাথে ধ্বংসশীল আদম সন্তান, ইয়াজূজ-মাজূজ এবং ইবলিস সন্তানেরা-ও থাকবে, যারা সবসময় বাড়তে থাকে (অর্থাৎ ওদের থেকে নয়শ নিরানব্বই জন জাহান্নামে, আর তোমাদের থেকে একজন জান্নাতে)। সবাই তখন আনন্দ ও তৃপ্তির নিশ্বাস ছাড়ল। আরো বললেন- আমল করে যাও! সুসংবাদ গ্রহণ কর! ঐ সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ নিহিত! মানুষের মাঝে তোমরা সেদিন ঊটের গায়ে ক্ষুদ্রচিহ্ন বা জন্তুর বাহুতে সংখ্যাচিহ্ন সদৃশ হবে।-” (তিরমিযী, মুসনাদে আহমদ)
অর্থাৎ হাশরের ময়দানে ইয়াজূজ-মাজূজ, পূর্ববর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি এবং ইবলিস বংশধরদের উপস্থিতিতে তোমাদেরকে মুষ্টিমেয়
মনে হবে। ঠিক উটের গলায় ক্ষুদ্র চিহ্ন আঁকলে যেমন দেখা যায়, হাশরের ময়দানেও তোমাদের তেমন দেখাবে।
* হযরত খালেদ বিন আব্দুল্লাহ -আপন খালা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন- একদা নবী করীম সা. বিচ্ছু দংশনের ফলে মাথায় বেন্ডিস বাঁধাবস্থায় ছিলেন। বললেন- তোমরা তো মনে কর যে, তোমাদের কোন শত্রু নেই! (অবশ্যই নয়; বরং শত্রু আছে এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে)
তোমরা যুদ্ধ করতে থাকবে। অবশেষে ইয়াজূজ-মাজূজের উদ্ভব হবে। প্রশস্ত চেহারা, ক্ষুদ্র চোখ, কৃষ্ণ-চুলে আবছা রক্তিম। প্রত্যেক উচ্চভূমি থেকে তারা দ্রুত ছুটে আসবে। মনে হবে, তাদের চেহারা সুপরিসরবর্ম।” (মুসনাদে আহমদ, তাবারানী)
ইয়াজুজ-মাজুজও আমাদের মতই স্বাভাবিক ভাবেই বাস করছেঃ
যেভাবে প্রাচীর ভেঙে যাবে যুলকারনাইনের নির্মিত সুদৃঢ় প্রাচীরের দরুন দীর্ঘকাল তারা আমাদের পৃথিবীতে আসতে পারেনি। প্রাচীরের ওপারে অবশ্যই নিজস্ব পদ্ধতিতে তারা জীবন যাপন করছে। তবে অদ্যাবধি তারা সেই প্রাচীর ভাঙতে নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, প্রাচীরের বর্ণনা দিতে গিয়ে নবী করীম সা. বলেন- “অতঃপর প্রতিদিন তারা প্রাচীর ছেদনকার্যে লিপ্ত হয়। ছিদ্র করতে করতে যখন পুরোটা উম্মোচনের উপক্রম হয়, তখনি তাদের একজন বলে, আজ তো অনেক করলাম, চল! বাকীটা আগামীকাল করব! পরদিন আল্লাহ পাক সেই প্রাচীরকে পূর্বে থেকেও শক্ত ও মজবুতরূপে পূর্ণ করে দেন। অতঃপর যখন সে-ই সময় আসবে এবং আল্লাহ পাক তাদেরকে বের হওয়ার অনুমতি দেবেন, তখন তাদের একজন বলে উঠবে, আজ চল! আল্লাহ চাহেন তো আগামীকাল পূর্ণ খোদাই করে ফেলব! পরদিন পূর্ণ খোদাই করে তারা প্রাচীর ভেঙে বেরিয়ে আসবে। মানুষের ঘরবাড়ী বিনষ্ট করবে, সমুদ্রের পানি পান করে নিঃশেষ করে ফেলবে। ভয়ে আতঙ্কে মানুষ দূর দূরান্তে পলায়ন করবে। অতঃপর আকাশের দিকে তারা তীর ছুড়বে, তীর রক্তাক্ত হয়ে ফিরে আসবে।-” (তিরমিযী, মুসনাদে আহমদ, মুস্তাদরাকে হাকিম)
* হযরত যয়নব বিনতে জাহশ রা. থেকে বর্ণিত, একদা সন্ত্রস্ত চেহারায় নবী করীম সা. তার ঘরে প্রবেশ করে বললেন- “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই) ধিক আরবের! তাদের অনিষ্টতা কাছিয়ে গেছে।” হাতের দুই আঙ্গুলে ইশারা করে বললেন, ইয়াজূজ-মাজূজের প্রাচীর থেকে এতটুকু আজ উন্মোচিত হয়ে গেছে। বর্ণনাকারী জিজ্ঞেস করলেন- সৎ নিষ্ঠাবান ব্যক্তিবর্গ থাকতেও আমরা ধ্বংস হয়ে যাব? বললেন- হ্যাঁ..! পাপাচার বেড়ে গেলে তাই হবে!!” (বুখারী- মুসলিম)
* হযরত আবু সাঈদ রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন-
“আল্লাহ পাক আদমকে উদ্দেশ্য করে বলবেন- হে আদম! বলবে- উপস্থিত হে আল্লাহ! সকল কল্যাণ একমাত্র আপনার হাতেই! আল্লাহ বলবেন- জাহান্নামের উৎক্ষেপণ বের কর! আদম বলবে- জাহান্নামের উৎক্ষেপণ কি হে আল্লাহ!? আল্লাহ বলবেন- প্রতি হাজার থেকে নয়শ নিরানব্বই জন। শুনা মাত্রই আতঙ্কে শিশুর চুল সাদা হয়ে যাবে। গর্ভবতীর গর্ভপাত ঘটবে। মানুষকে সেদিন মাতাল মনে হবে; বাস্তবে মাতাল নয়, আল্লাহর আযাব বড় কঠিন। -সেই মুক্তিপ্রাপ্ত একজন কে হবে- প্রশ্নের উত্তরে নবীজী বললেন- সুসংবাদ গ্রহণ কর!
তোমাদের থেকে একজন এবং ইয়াজূজ-মাজূজ থেকে এক হাজার। একথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম – আল্লাহু আকবার- ধ্বনি দিল। নবীজী বললেন- তোমরা জান্নাতের একতৃতীয়াংশ হবে আমি আশা করি। সাহাবায়ে কেরাম আবার-ও আল্লাহু আকবার ধ্বনি উচ্চারণ করলেন।
নবীজী আর-ও বললেন- বরং তোমরা জান্নাতের অর্ধেক হবে আমি আশা করি। আবার-ও আল্লাহু আকবার ধ্বনি উচ্চারিত হল। (বুখারী)
* হযরত নাওয়াছ বিন ছামআন রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “অতঃপর আল্লাহ ইয়াজূজ- মাজূজকে বের করবেন। তারা প্রত্যেক উচ্চভূমি থেকে অবতরণ করবে। তাদের প্রথম দল বুহাইরা তাবারিয়া-য় এসে নিমিষেই সমস্ত পানি পান করে ফেলবে।
পরবর্তী দল এসে বলতে থাকবে- এখানে কোন কালে হয়ত পানি ছিল।-” (মুসলিম)
বুহাইরা তাবারিয়াঃ একে বুহাইরাতুল জালীল (জালীল উপসাগর)-ও বলা হয়। ইংরেজীতে টাইবেরিয়ান লেক। অধিকৃত উত্তর ফিলিস্তীনে অবস্থিত এ লেকটি জর্ডান নদীর সাথে যোগসূত্র স্থাপন করে আছে। লেক’টির দৈর্ঘ্য ২৩ কিঃ মিঃ। সর্বপ্রশস্ত ১৩ কিঃ মিঃ। গভীরতা ৪৪ মিটারের বেশি হবে না। লেকটি সমুদ্র-পৃষ্ঠ থেকে ২১০ মিটার নিচুতে অবস্থিত।
নবী করীম সা. বলেন- “অতঃপর ইয়াজূজ-মাজূজ জেরুজালেমের -জাবালে খামর-এর দিকে গিয়ে বলবেঃ জমিনের অধিবাসীকে আমরা নিঃশেষ করেছি, এখন আসমানের অধিবাসীদের নিঃশেষ করব। একথা বলে তারা আসমানের দিকে তীর ছুড়তে থাকবে।
আল্লাহ তাদের তীরকে রক্তিম করে ফিরিয়ে দেবেন। ঈসা ও তাঁর সাথীদেরকে অবরোধ করে ফেলা হবে। সেখানে তারা প্রচণ্ড ক্ষুধা এবং অভাবে দিন যাপন করবে। খাদ্যের অভাবে ষাঁঢ়ের মুণ্ডু সেদিন একশ দিনারের চেয়ে-ও বেশি মূল্যের হবে। অতঃপর ঈসা ও তাঁর সাথীদের দোয়ার প্রেক্ষিতে আল্লাহ ইয়াজূজ- মাজূজদের স্কন্ধে এক প্রকার পোকা তৈরি করে দেবেন। ফলে নিমিষেই তারা ধ্বংসমুখে পতিত হবে। অতঃপর ঈসা ও তাঁর সাথীগণ তূর পর্বত থেকে নেমে এসে দেখবেন, ভূমিতে এক বিঘত পরিমাণ জায়গাও অবশিষ্ট নেই;
সর্বত্র তাদের লাশ পড়ে আছে। দুর্গন্ধে পরিবেশ ভারী হয়ে আছে। ঈসা ও তাঁর সাথীগণ আবার-ও দোয়া করবেন। আল্লাহ পাক বড় ঊটের গলাসদৃশ বিরল কিছু পাখী পাঠাবেন। পাখীগুলো এসে ইয়াজূজ- মাজূজদের লাশগুলো আল্লাহর আদেশকৃত স্থানে ফেলে আসবে।
অতঃপর আল্লাহ জমিনে বরকতময় বৃষ্টি দিয়ে সকল জনপদ ও ঘরবাড়ীগুলো ধুয়ে দেবেন। সারা পৃথিবী আয়নার মত পরিস্কার হয়ে যাবে। অতঃপর বলা হবে- হে জমিন! ফসল উদগত কর! বরকত প্রকাশ কর! সেদিন একটি ডালিম একাধিক ব্যক্তিকে পরিতৃপ্ত করবে।
মানুষ ডালিমের খোলসকে ছায়াদানের কাজে ব্যবহার করবে। দুধের বরকত ফিরে আসবে। একটি মাত্র ঊষ্ট্রীর দুধ সেদিন বহু লোক মিলে পান করতে পারবে। গরুর দুধ সেদিন সারা গোত্রের মানুষের জন্য যথেষ্ট হবে। বকরির দুধ সেদিন আত্মীয় স্বজন সবার জন্য যথেষ্ট হবে। এভাবে মুমিনগণ জীবনযাপন করতে থাকবেন। অবশেষে আল্লাহ মুমিনদের রূহ কব্জা করতে এক প্রকার সুবাতাস পাঠাবেন। বাহুমূলে স্পর্শিত হওয়া মাত্রই মুমিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। পৃথিবীতে কোন মুমিন অবশিষ্ট থাকবে না; থাকবে শুধু দুষ্ট ও দুশ্চরিত্র লোক, যারা গাধার ন্যায় রাস্তাঘাটে কুকর্মে লিপ্ত হবে। তাদের উপর-ই কেয়ামতের কঠিন আযাব নিপতিত হবে।-” (মুসলিম)
অপর হাদিসে- “মুমিনগণ ইয়াজূজ-মাজূজের নিক্ষেপিত তীর-ধনুক দিয়ে সাত বৎসর পর্যন্ত লাকড়ির কাজ চালাবে।
* হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
“মেরাজের রাত্রিতে নবীজী, ইবরাহীম, মূসা ও ঈসা আ. মিলে কেয়ামত প্রসঙ্গে আলোচনা করছিলেন। সবাই মিলে ঈসাকে বলতে বললে ঈসা আ. বললেন- দাজ্জাল হত্যার পর সকলেই নিজ নিজ দেশে গিয়ে দেখবে ইয়াজূজ-মাজূজ বেরিয়ে এসেছে। সবাই দ্রুত পালিয়ে আমার কাছে চলে আসবে। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করব। আল্লাহ ইয়াজূজ- মাজূজকে ধ্বংস করে দেবেন। সর্বত্রই তাদের পঁচা লাশ পড়ে থাকবে। আবার আল্লাহর কাছে দোয়া করব। আল্লাহ আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করে তাদের লাশগুলিকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করবেন।-” (মুসনাদে আহমদ, মুস্তাদরাকে হাকিম)
-Najmul hassaan
ইয়াজুজ ও মাজুজ রহস্যঃ
ইয়াজূজ এবং মাজূজ হচ্ছে আদম সন্তানের মধ্যে দু’-টি গোত্র, যেমনটি হাদিস এবং বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। তাদের মধ্যে কিছু মানুষ অস্বাভাবিক বেঁটে, আবার কিছু অস্বাভাবিক লম্বা।তারা হচ্ছে সাধারণ আদম সন্তান। বাদশা যুল কারনাইনের যুগে তারা অত্যাধিক বিশৃঙ্খল জাতি হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল। অনিষ্টতা থেকে মানুষকে বাঁচাতে যুল কারনাইন তাদের প্রবেশ পথে বৃহৎ প্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন।নিচে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আসছেঃ ঐতিহাসিক সেই প্রাচীর নির্মাণ যুল কারনাইনের আলোচনা করতে গিয়ে আল্লাহ পাক বলেন- “আবার সে পথ চলতে লাগল। অবশেষে যখন সে দুই পর্বত প্রাচীরের মধ্যস্থলে পৌঁছল, তখন সেখানে এক জাতিকে পেল, যারা তাঁর কথা একেবারেই বুঝতে পারছিল না। তারা বললঃ হে যুলকারনাইন! ইয়াজূজ ও মাজূজ দেশে অশান্তি সৃষ্টি করেছে। আপনি বললে আমরা আপনার জন্যে কিছু কর ধার্য করব এই শর্তে যে, আপনি আমাদের ও তাদের মধ্যে একটি প্রাচীর নির্মাণ করে দেবেন। সে বললঃ আমার পালনকর্তা আমাকে যে সামর্থ দিয়েছেন, তাই যথেষ্ট। অতএব, তোমরা আমাকে শ্রম দিয়ে সাহায্য কর। আমি তোমাদের ও তাদের মধ্যে একটি সুদৃঢ় প্রাচীর নির্মাণ করে দেব। তোমরা আমাকে লোহার পাত এনে দাও। অবশেষে যখন পাহাড়ের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান পূর্ণ হয়ে গেল, তখন সে বললঃ তোমরা হাঁপরে দম দিতে থাক। অবশেষে যখন তা আগুনে পরিণত হল, তখন সে বললঃ তোমরা গলিত তামা নিয়ে এসো, আমি তা এর উপরে ঢেলে দেই। অতঃপর ইয়াজূজ ও মাজূজ তার উপরে আরোহণ করতে পারল না এবং তা ভেদ করতে-ও সক্ষম হল না।” (সূরা কাহফ ৯২-৯৭)
বংশধারাঃ
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, তারা হচ্ছে আদম সন্তানের-ই এক সম্প্রদায়। হাফেয ইবনে হাজার রহ.এর মতে- তারা নূহ আ.-এর পুত্র ইয়াফিছের পরবর্তী বংশধর। ইমরান বিন হুছাইন রা. থেকে বর্ণিত, কোন এক ভ্রমণে আমরা নবীজী সাথে ছিলাম। সাথীগণ বাহন নিয়ে এদিক-সেদিক ছড়িয়ে পড়ল। নবীজী উচ্চকণ্ঠে পাঠ করলেন- “হে লোক সকল! তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর। নিশ্চয় কেয়ামতের প্রকম্পন একটি ভয়ংকর ব্যাপার। যেদিন তোমরা তা প্রত্যক্ষ করবে, সেদিন প্রত্যেক স্তন্যধাত্রী তার দুধের শিশুকে ভুলে যাবে এবং প্রত্যেক গর্ভবতী তার গর্ভপাত করবে এবং মানুষকে তুমি দেখবে মাতাল; অথচ তারা মাতাল নয় বস্তুতঃ আল্লাহর আযাব বড় কঠিন।” (সূরা হাজ্ব ১-২)
নবীজীর উচ্চবাক্য শুনে সাহাবাগণ একত্রিত হতে লাগলেন, সবাই জড়ো হলে বলতে লাগলেন- “তোমরা কি জান- আজ কোন দিবস? আজ হচ্ছে সেই দিবস, যে দিবসে আদমকে লক্ষ্য করে আল্লাহ বললেনঃ জাহান্নামের উৎক্ষেপণ বের কর! আদম বলবেঃ জাহান্নামের উৎক্ষেপণ কি হে আল্লাহ..!? আল্লাহ বলবেন- প্রতি হাজারে নয়শ নিরানব্বই জন জাহান্নামে আর একজন শুধু জান্নাতে!! নবীজীর কথা শুনে সাহাবাদের চেহারায় ভীতির ছাপ ফুটে উঠল। তা দেখে নবীজী বলতে লাগলেন- আমল করে যাও! সুসংবাদ গ্রহণ কর! সেদি তোমাদের সাথে ধ্বংসশীল আদম সন্তান, ইয়াজূজ-মাজূজ এবং ইবলিস সন্তানেরা-ও থাকবে, যারা সবসময় বাড়তে থাকে (অর্থাৎ ওদের থেকে নয়শ নিরানব্বই জন জাহান্নামে, আর তোমাদের থেকে একজন জান্নাতে)। সবাই তখন আনন্দ ও তৃপ্তির নিশ্বাস ছাড়ল। আরো বললেন- আমল করে যাও! সুসংবাদ গ্রহণ কর! ঐ সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ নিহিত! মানুষের মাঝে তোমরা সেদিন ঊটের গায়ে ক্ষুদ্রচিহ্ন বা জন্তুর বাহুতে সংখ্যাচিহ্ন সদৃশ হবে।-” (তিরমিযী, মুসনাদে আহমদ)
অর্থাৎ হাশরের ময়দানে ইয়াজূজ-মাজূজ, পূর্ববর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি এবং ইবলিস বংশধরদের উপস্থিতিতে তোমাদেরকে মুষ্টিমেয়
মনে হবে। ঠিক উটের গলায় ক্ষুদ্র চিহ্ন আঁকলে যেমন দেখা যায়, হাশরের ময়দানেও তোমাদের তেমন দেখাবে।
* হযরত খালেদ বিন আব্দুল্লাহ -আপন খালা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন- একদা নবী করীম সা. বিচ্ছু দংশনের ফলে মাথায় বেন্ডিস বাঁধাবস্থায় ছিলেন। বললেন- তোমরা তো মনে কর যে, তোমাদের কোন শত্রু নেই! (অবশ্যই নয়; বরং শত্রু আছে এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে)
তোমরা যুদ্ধ করতে থাকবে। অবশেষে ইয়াজূজ-মাজূজের উদ্ভব হবে। প্রশস্ত চেহারা, ক্ষুদ্র চোখ, কৃষ্ণ-চুলে আবছা রক্তিম। প্রত্যেক উচ্চভূমি থেকে তারা দ্রুত ছুটে আসবে। মনে হবে, তাদের চেহারা সুপরিসরবর্ম।” (মুসনাদে আহমদ, তাবারানী)
ইয়াজুজ-মাজুজও আমাদের মতই স্বাভাবিক ভাবেই বাস করছেঃ
যেভাবে প্রাচীর ভেঙে যাবে যুলকারনাইনের নির্মিত সুদৃঢ় প্রাচীরের দরুন দীর্ঘকাল তারা আমাদের পৃথিবীতে আসতে পারেনি। প্রাচীরের ওপারে অবশ্যই নিজস্ব পদ্ধতিতে তারা জীবন যাপন করছে। তবে অদ্যাবধি তারা সেই প্রাচীর ভাঙতে নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, প্রাচীরের বর্ণনা দিতে গিয়ে নবী করীম সা. বলেন- “অতঃপর প্রতিদিন তারা প্রাচীর ছেদনকার্যে লিপ্ত হয়। ছিদ্র করতে করতে যখন পুরোটা উম্মোচনের উপক্রম হয়, তখনি তাদের একজন বলে, আজ তো অনেক করলাম, চল! বাকীটা আগামীকাল করব! পরদিন আল্লাহ পাক সেই প্রাচীরকে পূর্বে থেকেও শক্ত ও মজবুতরূপে পূর্ণ করে দেন। অতঃপর যখন সে-ই সময় আসবে এবং আল্লাহ পাক তাদেরকে বের হওয়ার অনুমতি দেবেন, তখন তাদের একজন বলে উঠবে, আজ চল! আল্লাহ চাহেন তো আগামীকাল পূর্ণ খোদাই করে ফেলব! পরদিন পূর্ণ খোদাই করে তারা প্রাচীর ভেঙে বেরিয়ে আসবে। মানুষের ঘরবাড়ী বিনষ্ট করবে, সমুদ্রের পানি পান করে নিঃশেষ করে ফেলবে। ভয়ে আতঙ্কে মানুষ দূর দূরান্তে পলায়ন করবে। অতঃপর আকাশের দিকে তারা তীর ছুড়বে, তীর রক্তাক্ত হয়ে ফিরে আসবে।-” (তিরমিযী, মুসনাদে আহমদ, মুস্তাদরাকে হাকিম)
* হযরত যয়নব বিনতে জাহশ রা. থেকে বর্ণিত, একদা সন্ত্রস্ত চেহারায় নবী করীম সা. তার ঘরে প্রবেশ করে বললেন- “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই) ধিক আরবের! তাদের অনিষ্টতা কাছিয়ে গেছে।” হাতের দুই আঙ্গুলে ইশারা করে বললেন, ইয়াজূজ-মাজূজের প্রাচীর থেকে এতটুকু আজ উন্মোচিত হয়ে গেছে। বর্ণনাকারী জিজ্ঞেস করলেন- সৎ নিষ্ঠাবান ব্যক্তিবর্গ থাকতেও আমরা ধ্বংস হয়ে যাব? বললেন- হ্যাঁ..! পাপাচার বেড়ে গেলে তাই হবে!!” (বুখারী- মুসলিম)
* হযরত আবু সাঈদ রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন-
“আল্লাহ পাক আদমকে উদ্দেশ্য করে বলবেন- হে আদম! বলবে- উপস্থিত হে আল্লাহ! সকল কল্যাণ একমাত্র আপনার হাতেই! আল্লাহ বলবেন- জাহান্নামের উৎক্ষেপণ বের কর! আদম বলবে- জাহান্নামের উৎক্ষেপণ কি হে আল্লাহ!? আল্লাহ বলবেন- প্রতি হাজার থেকে নয়শ নিরানব্বই জন। শুনা মাত্রই আতঙ্কে শিশুর চুল সাদা হয়ে যাবে। গর্ভবতীর গর্ভপাত ঘটবে। মানুষকে সেদিন মাতাল মনে হবে; বাস্তবে মাতাল নয়, আল্লাহর আযাব বড় কঠিন। -সেই মুক্তিপ্রাপ্ত একজন কে হবে- প্রশ্নের উত্তরে নবীজী বললেন- সুসংবাদ গ্রহণ কর!
তোমাদের থেকে একজন এবং ইয়াজূজ-মাজূজ থেকে এক হাজার। একথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম – আল্লাহু আকবার- ধ্বনি দিল। নবীজী বললেন- তোমরা জান্নাতের একতৃতীয়াংশ হবে আমি আশা করি। সাহাবায়ে কেরাম আবার-ও আল্লাহু আকবার ধ্বনি উচ্চারণ করলেন।
নবীজী আর-ও বললেন- বরং তোমরা জান্নাতের অর্ধেক হবে আমি আশা করি। আবার-ও আল্লাহু আকবার ধ্বনি উচ্চারিত হল। (বুখারী)
* হযরত নাওয়াছ বিন ছামআন রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “অতঃপর আল্লাহ ইয়াজূজ- মাজূজকে বের করবেন। তারা প্রত্যেক উচ্চভূমি থেকে অবতরণ করবে। তাদের প্রথম দল বুহাইরা তাবারিয়া-য় এসে নিমিষেই সমস্ত পানি পান করে ফেলবে।
পরবর্তী দল এসে বলতে থাকবে- এখানে কোন কালে হয়ত পানি ছিল।-” (মুসলিম)
বুহাইরা তাবারিয়াঃ একে বুহাইরাতুল জালীল (জালীল উপসাগর)-ও বলা হয়। ইংরেজীতে টাইবেরিয়ান লেক। অধিকৃত উত্তর ফিলিস্তীনে অবস্থিত এ লেকটি জর্ডান নদীর সাথে যোগসূত্র স্থাপন করে আছে। লেক’টির দৈর্ঘ্য ২৩ কিঃ মিঃ। সর্বপ্রশস্ত ১৩ কিঃ মিঃ। গভীরতা ৪৪ মিটারের বেশি হবে না। লেকটি সমুদ্র-পৃষ্ঠ থেকে ২১০ মিটার নিচুতে অবস্থিত।
নবী করীম সা. বলেন- “অতঃপর ইয়াজূজ-মাজূজ জেরুজালেমের -জাবালে খামর-এর দিকে গিয়ে বলবেঃ জমিনের অধিবাসীকে আমরা নিঃশেষ করেছি, এখন আসমানের অধিবাসীদের নিঃশেষ করব। একথা বলে তারা আসমানের দিকে তীর ছুড়তে থাকবে।
আল্লাহ তাদের তীরকে রক্তিম করে ফিরিয়ে দেবেন। ঈসা ও তাঁর সাথীদেরকে অবরোধ করে ফেলা হবে। সেখানে তারা প্রচণ্ড ক্ষুধা এবং অভাবে দিন যাপন করবে। খাদ্যের অভাবে ষাঁঢ়ের মুণ্ডু সেদিন একশ দিনারের চেয়ে-ও বেশি মূল্যের হবে। অতঃপর ঈসা ও তাঁর সাথীদের দোয়ার প্রেক্ষিতে আল্লাহ ইয়াজূজ- মাজূজদের স্কন্ধে এক প্রকার পোকা তৈরি করে দেবেন। ফলে নিমিষেই তারা ধ্বংসমুখে পতিত হবে। অতঃপর ঈসা ও তাঁর সাথীগণ তূর পর্বত থেকে নেমে এসে দেখবেন, ভূমিতে এক বিঘত পরিমাণ জায়গাও অবশিষ্ট নেই;
সর্বত্র তাদের লাশ পড়ে আছে। দুর্গন্ধে পরিবেশ ভারী হয়ে আছে। ঈসা ও তাঁর সাথীগণ আবার-ও দোয়া করবেন। আল্লাহ পাক বড় ঊটের গলাসদৃশ বিরল কিছু পাখী পাঠাবেন। পাখীগুলো এসে ইয়াজূজ- মাজূজদের লাশগুলো আল্লাহর আদেশকৃত স্থানে ফেলে আসবে।
অতঃপর আল্লাহ জমিনে বরকতময় বৃষ্টি দিয়ে সকল জনপদ ও ঘরবাড়ীগুলো ধুয়ে দেবেন। সারা পৃথিবী আয়নার মত পরিস্কার হয়ে যাবে। অতঃপর বলা হবে- হে জমিন! ফসল উদগত কর! বরকত প্রকাশ কর! সেদিন একটি ডালিম একাধিক ব্যক্তিকে পরিতৃপ্ত করবে।
মানুষ ডালিমের খোলসকে ছায়াদানের কাজে ব্যবহার করবে। দুধের বরকত ফিরে আসবে। একটি মাত্র ঊষ্ট্রীর দুধ সেদিন বহু লোক মিলে পান করতে পারবে। গরুর দুধ সেদিন সারা গোত্রের মানুষের জন্য যথেষ্ট হবে। বকরির দুধ সেদিন আত্মীয় স্বজন সবার জন্য যথেষ্ট হবে। এভাবে মুমিনগণ জীবনযাপন করতে থাকবেন। অবশেষে আল্লাহ মুমিনদের রূহ কব্জা করতে এক প্রকার সুবাতাস পাঠাবেন। বাহুমূলে স্পর্শিত হওয়া মাত্রই মুমিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। পৃথিবীতে কোন মুমিন অবশিষ্ট থাকবে না; থাকবে শুধু দুষ্ট ও দুশ্চরিত্র লোক, যারা গাধার ন্যায় রাস্তাঘাটে কুকর্মে লিপ্ত হবে। তাদের উপর-ই কেয়ামতের কঠিন আযাব নিপতিত হবে।-” (মুসলিম)
অপর হাদিসে- “মুমিনগণ ইয়াজূজ-মাজূজের নিক্ষেপিত তীর-ধনুক দিয়ে সাত বৎসর পর্যন্ত লাকড়ির কাজ চালাবে।
* হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
“মেরাজের রাত্রিতে নবীজী, ইবরাহীম, মূসা ও ঈসা আ. মিলে কেয়ামত প্রসঙ্গে আলোচনা করছিলেন। সবাই মিলে ঈসাকে বলতে বললে ঈসা আ. বললেন- দাজ্জাল হত্যার পর সকলেই নিজ নিজ দেশে গিয়ে দেখবে ইয়াজূজ-মাজূজ বেরিয়ে এসেছে। সবাই দ্রুত পালিয়ে আমার কাছে চলে আসবে। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করব। আল্লাহ ইয়াজূজ- মাজূজকে ধ্বংস করে দেবেন। সর্বত্রই তাদের পঁচা লাশ পড়ে থাকবে। আবার আল্লাহর কাছে দোয়া করব। আল্লাহ আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করে তাদের লাশগুলিকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করবেন।-” (মুসনাদে আহমদ, মুস্তাদরাকে হাকিম)
-Najmul hassaan
No comments:
Post a Comment