Thursday, April 9, 2015

ইসলামী ব্যাংকিং

Source LINK 

ইসলামী ব্যাংকিং বনাম শামীম-বারাকাতীয় অর্থনীতি  

লেখক ---- এন.এম.শহীদ উল্লাহ

আধুনিক সমাজের অন্যতম আবশ্যকীয় উপাদান ব্যাংক। অর্থ লেনদেন, সঞ্চয়, বিনিয়োগ, স্থানান্তর, রাজস্ব, উৎপাদন, ভোগ ব্যবস্থাপনা সহ সকল ক্ষেত্রে ব্যাংকের ভূমিকা অপরিসীম।

প্রচলিত ব্যংকিং ব্যবস্থা সুদ ভিত্তিক হওয়ায় তা অনেকের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশে শতকরা ৮৮ ভাগ লোক মুসলিম হলেও পুরোপুরি ইসলামী শরীয়া অনুসরণ করেন বা এর যাবতীয় বিধি বিধান যারা মেনে চলতে চেষ্টা করেন, তাদের নিকট ইসলামী শরীয়া অনুসারে পরিচালিত ব্যাংকিং ব্যবস্থা আশীর্বাদ স্বরূপ।

অর্থনীতিতে সুদের উদ্ভব:

বিশ্বে প্রচলিত অর্থনীতির নীতি পদ্ধতি, ব্যবসা বাণিজ্যে নৈতিকতার ক্ষেত্রে উন্নত ধ্যান ধারণার জন্মদানকারী শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এর নবুওয়াত কালে আল্লাহ যখন সুদ নিষিদ্ধ করেন, সে থেকে মোঘল আমল পর্যন্ত প্রায় সুদীর্ঘ হাজার বছরের অধিককাল মুসলিম শাসনামলে সুদবিহীন আর্থিক ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল এবং তখনকার যাবতীয় ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সুদের লেশমাত্র ছিলনা।
মহানবী (সঃ) এর যুগে সুদের কারবারী ছিল ইহুদীগণ। ইহুদীরা হচ্ছে এ পৃথিবীর সবচেয়ে অভিশপ্ত জাতি। তাদের স্বভাব হচ্ছে আল্লাহর যে কোন বিধানকে অস্বীকার করা, অমান্য করা। এমনকি নিজেদের খেয়ালখুশীরবীকে তারা হত্যা করেছে। তাছাড়া স্বভাব সুলভ মুসলিম বিদ্বেষ তাদেরকে সুদের লেনদেন বৃদ্ধিতে প্ররোচিত করছে।
ইসলামী সংস্কৃতি ও জীবনধারার প্রধান উৎস আল কুরআনের সাথে মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সম্পর্ক ছিন্ন হবার ফলে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও বাহ্যিক আগ্রাসনের শিকারে পরিণত হওয়া আদর্শচ্যুত মুসলমানদের অসংহত, ক্ষয়িষ্ণু ও বিক্ষিপ্ত অবস্থায় জ্ঞানবিজ্ঞানের কেন্দ্র স্পেন, কর্ডোভা, বাগদাদ ও মধ্য এশিয়া হালাকুখানদের হাতে ধ্বংস হয়। কুরআন বিচ্যুত সম্বিতহারা দিকভ্রান্ত মুসলমানদের এ পতনকালে চৌদ্দ ও ষোলশতকের ইউরোপীয় রেনেসাঁর পর পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মুসলিমদের মাঝে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি করে কুরআনের প্রভাবমুক্ত বিকৃত আদর্শের প্রসার ঘটাতে সক্ষম হয়।
দ্বীনি শিক্ষা থেকে ক্রমশঃ দূরে সরে যাওয়া, ঈমানী দুর্বলতা, সম্পদের প্রতি অতিরিক্ত মোহ, ক্ষমতালি≈v এবং সর্বোপরি ইহুদী খৃষ্টানদের প্ররোচনা মুসলিম নামধারী কিছু লোককে সুদী লেনদেন করতে উৎসাহ যুগিয়েছে। ফলে মুসলিম বিশ্বে লাভের ছদ্মাবরণে বিনা ঝুঁকিতে বেশী অর্থের মালিক হওয়ার লোভে অনেকটা মনের অজান্তেই সুদ নামক বিষ বৃক্ষটি বিরাট মহীরূহ হয়ে সমাজে গেঁড়ে বসেছে। মাত্র দু'শ বছরের ব্রিটিশ শাসনে চির মুসলিম বিদ্বেষী তৎকালিন হিন্দু চাটুকারদের সহযোগীতায় মুসলিমদেরকে দমনের অদম্য বাসনা থেকে ব্রিটিশ রাজন্য ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নামক লুটেরা বনিকদের শোষণের হাতিয়ার স্বরূপ এ উপমহাদেশে সুদী লেনদেনের বিস্তৃতি ঘটে।
ইসলামের নৈতিক শিক্ষা বঞ্চিত হয়ে জাগতিক উন্নতির সকল চাবিকাঠি ও মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যায়। ফলতঃ সে স্থান পূরণার্থে যে নব সভ্যতার উদ্ভব হয় তার লক্ষ্য, আদর্শ ও বাণী ছিল মুসলমানদের সভ্যতা সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক। পশ্চিমা জড়বাদী সভ্যতার সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী হাতিয়ার ও শোষণযন্ত্ররূপে হাজির হলো সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থা। ইহুদীরাই প্রথমে ব্যাংক ব্যাবস্থায় সুদের প্রচলন করে। খৃষ্টানরা গোড়াতে এর বিরোধীতা করলেও মুসলিম বিদ্বেষের ফলে পরে ইহুদীদের সাথে হাত মিলিয়ে সুদী কারবারে জড়িয়ে পড়ে।

সুদের   প্রভাবঃ

রাষ্ট্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এ জঘন্য জিনিষটি সমাজকে এত বেশি আচ্ছন্ন করেছে যে, এর ফলে সমাজে সুদী লেনদেনকারী নামক একটি গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছে। যাদেরকে এ উপমহাদেশে বনিক শ্রেণী নমে অভিহিত করা হয়েছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ব্যবসা-বাণিজ্য, পারস্পরিক লেনদেন, ব্যাংকিং কিংবা স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সকল ক্ষেত্রে সুদবিহীন কোন কিছুর অস্তিত্বও কল্পনা করা যাচ্ছেনা বলে মনে হয়। আমরা এক পর্যায়ে ভুলেই গেছি যে, সুদবিহীন ব্যাংক ও অর্থব্যবস্থা চলতে পারে। এমনকি অনেক বড় বড় পরহেজগার হিসাবে পরিচিত ব্যক্তি, যিনি সাধারণ কোন ছোট সুন্নতও তরক করেন বলে মনে হয় না, সে ব্যক্তিও সুদের এ জঘন্য অপরাধকে গুনাহ বলেই মনে করেন না। ফলতঃ তাঁর সকল আর্থিক লেনদেন সুদী ব্যাংকের সাথেই হচ্ছে / চলছে। এ বিষয়টি তাঁর পরহেজগারীর কোন ক্ষতি করছে বলেও তিনি মনে করেননা। কিংবা আদৌ এটি গুনাহ কিনা তাও তাঁর মনে উদয় হয় না। অথচ আল্লাহ সুদের লেনদেনকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন যা অন্য কোন গুনাহের জন্য দেননি।

সুদের বিরুদ্ধে আধুনিক অর্থনীতিবিদ ঃ

সমাজতন্ত্র ব্যবস্থার স্রষ্টা কার্ল মার্ক্স সুদের ব্যবসায়ীদেরকে ‘‘বিকট শয়তান’’, ‘‘ডাকাত’’ ও ‘‘সিদেঁল চোর’’ নামে অভিহিত করেছেন। সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিতে সুদ শ্রমিক সমাজের উপর একটি অসহনীয় বোঝা স্বরূপ।
আধুনিক পুঁজিবাদী অর্থনীতির অন্যতম সেরা অর্থনীতিবিদ লর্ড কীনস ১৯৩৩ সনের অর্থনৈতিক মন্দার জন্য সুদকে দায়ী করে এর মোকাবেলায় সুদের হার শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, ‘‘চেষ্টা করলে এক পুরুষের মধ্যেই সুদের হার শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব।’’ ১৯৮৪ সনে ওয়াশিংটনে আইএমএফ এর বার্ষিক সাধারণ সভায় স্বীকার করা হয়েছে যে, সুদের উচ্চ হারই বিশ্বের সর্বত্র উন্নযন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার অন্যতম কারণ।
গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল তাঁর ‘‘পলিটিক্স’’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘‘ অন্যান্য পণ্যের ন্যায় অর্থ ক্রয় বিক্রয় করা একটি কৃত্রিম জালিয়াতি ব্যবসা।’’
ইহুদী ধর্মগ্রন্থ Exodus এর ২২ তম স্তবকে বলা হয়েছে, ‘‘তোমরা যদি আমার কোন লোককে অর্থ ধার দাও, যারা গরীব, তবে তোমরা উত্তমর্ণ মহাজন হবে না এবং তোমরা তার কাছ থেকে সুদ আদায় করবেনা।’’
অর্থনীতিবিদ থমাস একুইনাস বলেছেন,‘‘ অর্থ থেকে এর ব্যবহার পৃথক করা যায়না। তাই অর্থের ব্যবহার করা মানে অর্থকে নিঃশেষ করে দেয়া। এক্ষেত্রে একবার ব্যবহারের মূল্য নেয়ার পর পুনরায় অর্থের মূল্য নেয়া হলে একই দ্রব্যকে দুইবার বিক্রি করার অপরাধ হবে এবং দ্বিতীয়বার এমন দ্রব্যের মূল্য নেয়া হবে যা প্রকৃত পক্ষে বিক্রেতার দখলে নেই। নিঃসন্দেহে এটি একটি অবিচার।’’ সুদকে সময়ের মূল্য বলে দাবীদারদের যুক্তি খন্ডন করে তিনি আরও বলেন, ‘‘সময় এমন এক সাধারণ সম্পদ, যার উপর ঋণদাতা, ঋণগ্রহিতা সহ অন্যান্য সকল মানুষের সমান মালিকানা অধিকার রয়েছে। এমতাবস্থায় ঋণদাতা কর্তৃক সময়ের মূল্য দাবী একটি অসাধু ব্যবসা ও ভন্ডামী’’।

সুদবিহীন ব্যাংক, তত্ত্ব ও বাস্তবায়নঃ

ইসলামী শরীয়া কর্তৃক নিষিদ্ধকৃত সুদ বর্জনসাপেক্ষে অর্থনৈতিক লেনদেন ও কার্যক্রমের ভিত্তিতে ব্যাংকিং ব্যবসা পরিচালনা সম্ভব কিনা এ বিষয়ে তাত্ত্বিক পর্যায়ে বিংশ শতাব্দীতে অনেক গবেষনা হয়েছে এবং এতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চিন্তার রাজ্যে ঝড় তোলেন তিন বিশ্বখ্যাত মনিষী ও গবেষক আল্লামা ডঃ ইকবাল, হাসান আল বান্না ও মাওলানা মওদুদী (রঃ)। তাদের সে চিন্তাধারাকে আরো অগ্রসর করে চল্লিশের দশকে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ আনোয়ার ইকবাল কোরেশী ইসলামী ব্যাংকিং এর কাঠামোগত ধারনা পেশ করেন ১৯৫২ সালে শেখ মাহমুদ আহমদ তাঁর Economics of Islam প্রবন্ধে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিষয় উত্থাপন করেন। ১৯৫৫ সালে মোহাম্মদ উজায়ের তাঁর ’’An Outline of Interestless Banking" প্রবন্ধে ইসলামী ব্যাংকিং-এর কর্মপদ্ধতিতে মুদারাবা মূলনীতি সংযুক্ত করার কথা বলেন যা ১৯৬৬ সালে মোহাম্মদ আল আরাবী এবং ১৯৬৪ সালে এম.এ. ইরশাদ পুনর্ব্যক্ত করেন।
১৯৬৮ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. নেজাতুল্লাহ সিদ্দিকী ইসলামী ব্যাংকিং-এর দ্বিস্তর বিশিষ্ট মডেল উপস্থাপন করেন। পরবর্তীতে মুশারাকা পদ্ধতিতে ফান্ড ব্যবস্থাপনার দ্বিস্তর বিশিষ্ট মডেল উপস্থাপন করেন। ১৯৮২ সালে এম. মোহসীন আধুনিক পদ্ধতিতে ইসলামী ব্যাংকিং চালুর বিস্তৃত কাঠামোগত ধারণা পেশ করেন। ১৯৬১ সালে মিসরে ‘‘কলেজ অব ইসলামিক রিসার্চ’’ এবং ১৯৬২ সালে মালয়েশিয়ায় ‘‘পিলগ্রিমস সেভিংস কর্পোরেশন’’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামী পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করার জন্য ব্যাংকিং আদলে প্রায়োগিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘‘পিলগ্রিমস সেভিংস কর্পোরেশন’’ আধুনিক বিশ্বে প্রথম ‘রোপিত বিজ’’ যা ১৯৬৩ সালে ড. আহমদ আল নাজ্জারের উদ্যোগে রাজধানী কায়রো থেকে ১০০ কি.মি. দূরে মিটগামারে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চারাগাছে রূপান্তরিত হয়। ১৯৬৯ সালে মালয়েশিয়ার পার্লামেন্টে আইন করে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী শরীয়াভিত্তিক সঞ্চয় প্রতিষ্ঠান ‘‘তাবুং হাজী’’। ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত হয় ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের সনদ যার ভিত্তিতে ১৯৭৫ সালে আইডিবি প্রতিষ্ঠিত হয়। আইডিবি প্রতিষ্ঠার ০৫ বছরের মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ২০টিরও বেশী ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়, যার মধ্যে ডেনমার্ক, লুক্সেমবার্গ, সুইজারল্যন্ড ও যুক্তরাজ্যে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা অন্যতম উল্লেখযোগ্য।
১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর গোটা ব্যাংক ব্যবস্থা ইসলামী পদ্ধতিতে ঢেলে সাজানো হয়। ১৯৮১ সালে পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামী ব্যাংকিং চালুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং ১৯৮৫ সালের ১ জুলাই থেকে সুদভিত্তিক ব্যাংকিং লেনদেন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। মূলতঃ আশির দশকের শেষ নাগাদ সারা বিশ্বে ইসলামী ব্যাংক-এর সংখ্যা একশ' এরও বেশীতে পৌঁছে যায়, যার প্রায় দশ হাজারের মত শাখা খোলা হয়।
আশির দশকে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী ব্যাংকগুলোর সাফল্য নববই-এর দশকে ইসলামী ব্যাংকিং-এর প্রতি বিশ্বের ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে ইতিবাচক সাড়া জাগায়। ফলত তা নিয়ে নতুন নতুন গবেষণা ও নতুন ব্যাংকের উদ্ভব হয়। ফলশ্রুতিতে বিংশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ সারা বিশ্বে ইসলামী ব্যাংকের সংখ্যা তিশ'রও বেশী ছাড়িয়ে যায়। 

বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং ঃ 

১৯৭৪ সালের আগষ্ট মাসে আইডবি চার্টার স্বাক্ষর প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার ইসলামী শরীয়ার ভিত্তিতে অর্থনীতি ও ব্যাংকিং কার্যক্রম পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। কালের পথ পরিক্রমায় বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে এবং সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। তারপর একে একে আরও ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান জন্ম লাভ করে। সরকারী ব্যাংকগুলোসহ অনেক বেসরকারী ব্যাংক আলাদা ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডো খোলে এবং কেউ পুরোপুরিভাবে নিজেদের ইসলামী ব্যাংকিং-এ রূপান্তর করে। বর্তমানে ৭টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংক ও ৯টি ব্যাংকের ইসলামী উইন্ডো সহ বাংলাদেশে প্রায় ৬০০টির মত ইসলামী ব্যাংকিং শাখা কাজ করছে যার প্রায় বিশ হাজারের মতকর্মী বাহিনী রয়েছে।

ইসলামী ব্যাংকিং বাস্তবতা ঃ

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রথম সুদমুক্ত ব্যাংক ‘‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৩ সালের ৩০ শে মার্চ এবং আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ১২ আগস্ট।
১৭৬৫ সালের ১২ আগস্ট দিল্লীর সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের নিকট থেকে বাংলার আর্থিক প্রশাসনের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। তার ২১৯ বছর পর একই তারিখে উপমহাদেশের প্রথম সুদবিহীন ব্যাংক চালুর মাধ্যমে এদেশের মানুষকে সুদের যাঁতাকল থেকে মুক্ত করার ধারায় ফিরিয়ে আনার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের যাত্রা শুরু হয়।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে পত্রিকায় প্রকাশিত ক্রোড়পত্রে এক নিবন্ধে বাংলাদেশের অর্থনীতি শাস্ত্রের অন্যতম দিকপাল বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের দাদা পীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণতম অধ্যাপক ডঃ এম. এন. হুদা বলেন, ‘‘ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থা তাত্ত্বিক যুদ্ধে জয়ী হয়েছে। এবার লাভ ক্ষতির শেয়ারের ভিত্তিতে সুদবিহীন ব্যাংকিং ব্যবস্থার পরিচালনাগত যুদ্ধে জয়ী হতে হবে। ....আমরা মুসলমান হিসেবে সুদমুক্ত ব্যাংক ব্যবস্থার উপযোগীতায় বিশ্বাস করি। তবু আমাদেরকে কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে এবং সাফল্যের জন্য প্রতীক্ষা করতে হবে।’’
বাংলাদেশে ইসলামী শরীয়া মোতাবেক পরিচালিত ব্যাংকিং চালুর দুই যুগ পর আজ বাস্তবতার নিরিখে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় ইসলামী ব্যাংকিং আজ পরিচালনাগত যুদ্ধে জয়ী হয়েছে। এবং সফলতার সাথে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে সারা দেশে ইসলামী ব্যাংকিং এর পক্ষে যে জনস্রোত তৈরি করেছে তার পথ ধরে অসংখ্য ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিজেদেরকে একই স্রোতে আত্মীকরণের মাধ্যমে ব্যাংকিং ব্যবস্থা ইসলামীকরণের পথে অনেক দূর অগ্রসর করে নিয়েছে। ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে যারা অবজ্ঞার সুরে বলেছিলেন, ‘‘দেখা যাক, কতদিন টিকে!’’ আজ তারাই ইসলামী ব্যাংকের সুবিধাভোগী বা নিজেরা ইসলামী ব্যাংকিং শাখা খুলেছেন বা অবসর জীবনে নিজেদের সারাজীবনের সঞ্চিত অর্থ ইসলামী ব্যাংকে জমা রেখে নিজেদেরকে ধন্য মনে করছেন। ১৬ টি ব্যাংকের ৬০০ টির মত শাখার বিশ হাজার কর্মী নিজেদের দক্ষতা, আন্তরিকতা, যোগ্যতা ও হৃদ্যতাপূর্ণ সেবা দিয়ে ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থায় শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন।
নতুন নতুন প্রোডাক্টের মাধ্যমে জনসাধারণের বিক্ষিপ্ত সঞ্চয়কে একীভূত করে অর্থনীতির মূলধারায় নিয়ে আসার কৃতিত্ব ইসলামী ব্যাংকগুলোর। ইসলামী ব্যাংক আসার পূর্বে বাংলাদেশের অসংখ্য লোক যারা কোনদিন ব্যাংকে টাকা রাখেননি সুদের ভয়ে, নিজেদের টাকা সিন্দুকে ভরে ঘরের ভিটির নীচে রেখে দিতেন, আজ তারাই ৫০০ টাকা হলেও ইসলামী ব্যাংকে নিয়ে আসছেন। দেশের মোট আর্থিক খাতের জমা ও বিনিয়োগের এক ষষ্ঠাংশ, বৈদেশিক আমদানী, রফতানি ও রেমিটেন্সের অর্ধেকেরও বেশি ইসলামী ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে সম্পাদিত হচ্ছে। দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট প্রবৃদ্ধি যেখানে ঋণাত্মক সেখানে ইসলামী ব্যাংকগুলোর প্রবৃদ্ধি শতকরা ৩০ ভাগেরও বেশী যা ইসলামী ব্যাংকিং এর সফলতার প্রমাণ।

ইসলামী ব্যাংকিং এর সাফল্য ঃ

প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইসলামী ব্যাংকিং বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের সফলতার স্বাক্ষর রেখেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ
১. সরকারের অগ্রাধিকার খাত সমূহ যথাঃ ক) তথ্য প্রযুক্তি খ) এসএমই গ) মহিলা উদ্যোক্তা তৈরি ঘ) কৃষি বিনিয়োগ ঙ) গ্রীন ব্যাংকিং চ) ক্ষুদ্র শিল্প ছ) দেশীয় শিল্পকে উৎসাহ প্রদান জ) আমদানী বিকল্প শিল্প সহ সকল সেক্টরে যেখানে প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থা সহ সরকারী ব্যাংকগুলোর কোন ভূমিকাই নেই সেখানে ইসলামী ব্যাংকের রয়েছে একচ্ছত্র আধিপত্য।
২. বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার খাত এসএমই, মহিলা উদ্যোক্তা ও কৃষি বিনিয়োগে ইসলামী ব্যাংকগুলোর অবদান শতকরা ষাট ভাগ।
৩. অপ্রচলিত পণ্যসহ বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের শীর্ষস্থান দখলকারী গার্মেন্টস ও সাদাসোনা চিংড়ি খাতে ইসলামী ব্যাংক পথপ্রদর্শনকারী এবং শীর্ষস্থানে রয়েছে।
৪. বাংলাদেশে বর্তমানে অভ্যন্তরীণ রেমিটেন্সের শতকরা ২৮ ভাগ এককভাবে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি: এর মাধ্যমে আসে।
৫. বহুজাতিক কোম্পানী গ্রামীণ ফোন ব্যতিত বাংলাদেশ সরকারকে সর্বোচ্চ কর্পোরেট ট্যাক্স প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হল এককভাবে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি:।
৬. কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আয়কর, কর্পোরেট ট্যাক্স, উৎস কর, সারচার্জ, সার্ভিস চার্জ এর আদায়কৃত ভ্যাটসহ ইত্যকার নানা খাত মিলিয়ে ইসলামী ব্যাংকগুলো তিনহাজার কোটি টাকার বেশী সরকারী রাজস্ব খাতে জমা করছে।
৭. সামাজিক দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের শীর্ষস্থান দখল করে আছে। বন্যদুর্গতদের সাহায্য, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, সিডর, আইলা, বিডিআর বিদ্রোহ, নিমতলির অগ্নিকান্ড সহ সকল জাতীয় দুর্যোগে সরকারী কোষাগারে জমা প্রদান এবং নিজেদের উদ্যোগে পুনর্বাসন ছাড়াও ব্যাংকের নিয়মিত কর্মসূচী যথা হাসপাতাল ক্লিনিক, দাতব্য চিকিৎসালয়, ভোকেশনাল ইনিস্টিটিউট, আশ্রয় কেন্দ্র, দুস্থ মহিলা পুনর্বাসন, প্রতিবন্ধি পুনর্বাসন, শিক্ষা বৃত্তি, এককালীন সাহায্য সকল ক্ষেত্রেই ইসলামী ব্যাংকের সমকক্ষ আর কোন প্রতিষ্ঠান নেই।

ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনাগত সাফল্যঃ

১. ডিসেম্বর ২০০৯ তারিখে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে মোট জমার পরিমাণ ছিল ৩০২৩ বিলিয়ন টাকা। তার মধ্যে ইসলামী ব্যাংকসমূহের অংশ হচ্ছে ৫২৮ বিলিয়ন বা ১৭.৩৫ ভাগ। দেশীয় অর্থনীতিতে এ সময় মোট বিনিয়োগ ছিল ২৫৩১ বিলিয়ন টাকা যার মধ্যে ইসলামী ব্যাংকসমূহের ছিল ৪৮৮ বিলিয়ন অর্থাৎ ১৯.২৭ ভাগ। (উল্লেখ্য সরকারী কোন জমা ও বিনিয়োগ ইসলামী ব্যাংকগুলো পায় না। শুধু বেসরকারী ও ব্যক্তি খাতের জমা ও বিনিয়োগ ইসলামী ব্যাংকগুলো পরিচালনা করছে।
২. মাত্র ১০০ টাকা দিয়ে হিসাব খোলার সংস্কৃতি চালু করার ফলে এবং প্রত্যন্ত পল্লী অঞ্চলে উন্নত প্রযুক্তির সেবা প্রদানের ফলে ইসলামী ব্যাংকগুলো গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের ব্যাংকে পরিণত হয়েছে।
৩. ‘‘সঞ্চয়-বিনিয়োগ-আয়’’ অর্থনীতির এ চক্র অনুসরণ করে ইসলামী ব্যাংক নিম্নবিত্ত মানুষের সামর্থ বৃদ্ধির জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ’’
৪. মানুষ ধারণা করে, বেসরকারী ব্যাংক মানে বেশী জমা, বেশী সার্ভিস চার্জ, বিশেষ শ্রেণীর মানুষের জন্য ব্যাংকিং। ইসলামী ব্যাংক মানুষের সে ধারণা বদলে দিয়েছে।
৫. ইসলামী ব্যাংকের পূর্ব নির্ধারিত তহবিল মূল্য না থাকায় উদ্যোক্তার চাহিদা না মেটা পর্যন্ত বিনিয়োগ অব্যাহত রেখে কাম্য মানের বিনিয়োগ নিশ্চিত করা সম্ভব। ফলে কম লাভজনক কিন্তু সমাজ উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ করতেও উদ্যোক্তা নিরুৎসাহিত হয় না, যা ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে।
৬. আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এখন বিশ্বের অনেক বিখ্যাত ও বড় ব্যাংক বাংলাদেশের এল/সি এর জন্য ইসলামী ব্যাংকের ‘‘এড কনফারমেশন’’ যোগ করেছে।
৭. পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রচলিত এনজিও এর ধারণার বাইরে উর্ধ্বমুখী উন্নয়ন তৎপরতা বৃদ্ধিকরে গ্রামের নিম্ন, নিম্ন-মধ্য আয়ের সেবামুলক শ্রমকে জাতীয় অর্থনীতিতে সংযুক্তকরণের লক্ষ্যে তাদেরকে কর্মমুখী ও অর্থনীতির মূল স্রোতে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে।
৮. দেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ‘‘ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং’’ স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে নিজের স্থান করে নিয়েছে। যার উপর অনার্স ও মাষ্টার্স কোর্স চালু হয়েছে, যা ১৫ বছর আগেও ছিল অকল্পনীয়।
৯. বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা ও গবেষণার পর ‘‘ইসলামী ব্যাংকিং গাইডলাইন ’’ অনুমোদন করেছে।
১০. কোম্পানী আইন, ব্যাংকিং কোম্পানী আইনে ইসলামী ব্যাংকিং টার্মিনোলজি স্বীকৃতি পেয়েছে। এসব পরিভাষাগুলো এখন আর এদেশের মানুষকে আলোচনা করে বুঝাতে হয় না, শব্দটি বললেই মানুষ বুঝতে পারে।
১১. নিউইয়র্ক ভিত্তিক ম্যাগাজিন ‘‘দি ইকোনমিষ্ট’’ ১৯৯৪ সালের ৬ই আগষ্ট প্রকাশিত ‘‘সার্ভে অব ইসলাম’’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘অতীতে বিশ্ববাসী মুসলিম স্পেন ও আন্দালুশিয়া থেকে আধুনিক শিল্প সংস্কৃতি বিষয়ে জেনেছিল এবং ইসলামের কাছ থেকে ইউনিভার্সিটি সম্পর্কে ধারণা নিয়েছিল। আর এখনকার বিশ্ব ইসলামের কাছ থেকে ইসলামী ব্যাংকিং এর আইডিয়া গ্রহণ করতে পারে।
১২. বর্তমানে শুধুমাত্র ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ এর জমা গ্রাহক সংখ্যা ৭০ লক্ষ এবং বিনিয়োগ গ্রাহক সংখ্যা ৬ লক্ষ এর উপর। পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের সদস্যগণসহ হিসাব করলে এর সংখ্যা আরও ১৫ লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে।
১৩. ইসলামী ব্যাংক সমুহের বিনিয়োগের ব্যাপ্তি হিসাব করলে দেখা যায় অধিকাংশ বিনিয়োগ সমাজের নিম্ন ও মধ্য লেভেলে। যা পবিত্র কোরআনে বর্ণিত সম্পদ সকল পর্যায়ে আবর্তনের হুকুম এর বাস্তবায়ন। তথ্য থেকে আমরা দেখি:
ব্যাপ্তি ভিত্তিক খাত ভিত্তিক
ব্যাপ্তি গ্রাহক সংখ্যা খাত শতকরা হার
৫০০০ - ৫ লক্ষ ২৩৮৪৯৬ জন শিল্প ৫৪%
৫ লক্ষ - ১০ লক্ষ ১১৫১২ জন বাণিজ্যিক (ক্রয়-বিক্রয়) ৩৩%
১০ লক্ষ - ২৫ লক্ষ ৭৪৭২ জন কৃষি ও সার ৭%
২৫ লক্ষ - ৫০ লক্ষ ২৭৮০ জন নির্মাণ ও আবাসিক ৭%
৫০ লক্ষ এর উপর ৩৯০০ জন পরিবহন, ২%
পল্লী উন্নয়ন, ডেইরি, পোল্ট্রি , ক্ষুদ্র ব্যবসা ইত্যাদি ৬%

১৪. দেশের সরকার ঘোষিত এসএমই বিনিয়োগে ইসলামী ব্যাংক ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সর্বমোট ৭০০ কোটি টাকা বিতরণ করেছে।
১৫. নারীর ক্ষমতায়ন, তাদেরকে স্বাবলম্বী করে তোলার ক্ষেত্রে মহিলা উদ্যোক্তা বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও ইসলামী ব্যাংকসমুহ এগিয়ে আছে ।
১৬. গ্রামীন অর্থনীতির বিকাশ, দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়নে অগ্রগতি অর্জনে প্রণীত দারিদ্র্য বিমোচন, কৌশলপত্র (পিআরএসপি) বাস্তবায়নে ইসলামী ব্যাংক পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও ছোট বিনিয়োগের মাধ্যমে দারিদ্র দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আয় বৃদ্ধি, বেকার ও কর্মহীন নারীদেরকে কর্মমুখী করে তোলা ও তাদের উৎপাদনশীলতাকে জাতীয় অর্থনীতিমুখী করার জন্য পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ১০৭৫১ টি গ্রামের ৫৭৭৭৪০ জন গ্রাহকের মাঝে ২৪২৪০ মিলিয়ন টাকা বিতরণ করেছে, যাদের মধ্যে শতকরা ৮৬ জন হচ্ছে মহিলা।
১৭. ৮০,০০০ হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারী প্রকল্পে প্রায় ৩৩২০ মিলিয়ন টাকা বিনিয়োগ করে সরকারী অগ্রাধিকার খাতে ও জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নমুলক কর্মকান্ডকে বেগবান করছে।
১৮. গ্রাম ও শহরের বেকার যুবকদের আত্মকর্মসংস্থান ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের সহযোগিতার উদ্দেশ্যে প্রায় ২০০ প্রকার অর্থনৈতিক কর্মকান্ড প্রায় ২২ হাজার গ্রাহকের মধ্যে ৪৫০ কোটি টাকারও বেশী অর্থ বিনিয়োগ করে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ব্যবসার গতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করছে।
১৯. সীমিত আয়ের সরকারী বেসরকারী ও আধাসরকারী চাকুরীজীবি সহ পেশাজীবিদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য কন্জুমার স্কীমের আওতায় প্রায় ২ লক্ষ গ্রাহকের মাঝে ৫৭৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।

এ যুগে ইসলামী ব্যাংকিংঃ 

বিশ্ব অর্থনীতি যখন সুদের যাঁতাকলে নিষ্ট, পশ্চিমা বিশ্ব যখন অর্থনৈতিক মন্দায় হাবুডুবু খাচ্ছে, বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি, খেলাপী ঋণে জর্জরিত, অনুৎপাদনশীল খাতে বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ হুমকির মুখে তখনও ইসলামী ব্যাংকগুলো তাদের প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রেখেছে।
বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দায় পশ্চিমা বিশ্বের জায়ান্টগুলো নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে- হয় উইন্ড আপ অথবা মার্জার এর মাধ্যমে নিজেদের নিভূ নিভূ প্রদীপ কোনভাবে জ্বালিয়ে রেখেছে, সেক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকগুলোর ক্রমপ্রবৃদ্ধি আধুনিক অর্থনীতিবিদদেরকে ইসলামী অর্থব্যবস্থা ও ব্যাংকব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে চিন্তা করতে বাধ্য করছে।

ইসলামী ব্যাংকগুলোর সাফল্যের কারণঃ 

১. উৎপাদনশীলখাতে বিনিয়োগ, ফলতঃ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, জনকল্যাণমূলক পণ্য উৎপাদন, গ্রাহক চাহিদা বৃদ্ধি, অধিক লাভ, নতুন বিনিয়োগ এবং নতুন কর্মসংস্থান।
২. ব্যাংকিং ব্যবস্থায় লালফিতার দৌরাত্ম্য ও হিডেন কষ্টের মূলোৎপাটন।
৩. জনকল্যাণমুলক, অধিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ততা, দারিদ্র্য বিমোচন, নতুন কর্মসংস্থান সহ সরকারী অগ্রাধিকার মুলক খাতে বিনিয়োগ।
৪. লাভের চেয়েও বিনিয়োগের বহুমুখীকরণে গুরুত্ব প্রদান।
৫. সমাজের সকল স্তরের মানুষদেরকে কর্মমুখী করে তোলার প্রচেষ্টা এবং মূল অর্থনৈতিক স্রোতে সম্পৃক্তকরণ।
৬. নারীর ক্ষমতায়ন সহ ছদ্মবেশী বেকারত্ব ও অনুৎপাদনশীল খাতে নিয়োজিত শ্রমকে উৎপাদনশীল কর্মকান্ডে উৎসাহিত করে অর্থনীতির মূলস্রোতে আনয়নের প্রচেষ্টা।
৭. গ্রামীন অর্থনীতির বিকাশে পল্লী এলাকায় অধিক শাখা খোলা এবং বিত্তহীন বা নিম্নবিত্তদেরকে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সংযুক্তকরণ।
৮. আধুনিক বিশ্বের অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি তথ্য প্রযুক্তিসহ উন্নতমানের দক্ষতাপূর্ণ সেবা, মুহূর্তের মধ্যে সারাবিশ্বের যেকোন স্থান থেকে প্রেরিত অর্থ প্রত্যন্ত পল্লীতে পৌঁছানোর মাধ্যমে বিশ্বকে হাতের মুঠোয় আনা এবং ব্যাংকিং সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো।

ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ নীতিঃ

১. ইসলামী শরীয়ার দৃষ্টিতে হালাল পদ্ধতিতে ও হালাল খাতে বিনিয়োগ।
২. মুনাফা অর্জন নয় সামাজিক কল্যাণের দিকেও নজর প্রদান। ফলতঃ ইসলামী ব্যাংকগুলো তামাক, সিগারেট মদ উৎপাদন বা ব্যবসায় কোন বিনিয়োগ করে না ।
৩. সমাজের মৌলিক চাহিদার ইসলামী ক্রম অগ্রাধিকার, পারিপার্শ্বিকতা ও পরিবেশ এবং দেশের সামগ্রিক চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখে বিনিয়োগ করা।
৪. অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় মূলধন ও দক্ষতার সমন্বয় ঘটিয়ে বৈজ্ঞানিক, কারিগরি, প্রযুক্তিগত ও পেশাগত সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তোলা।
৫. মুষ্টিমেয় লোকের হাতে সম্পদ পুঞ্জিভূত না করে সিংহভাগ মানুষের কাজে লাগানোর মাধ্যমে উৎপাদক ও উৎপাদনমুখী শিল্পের সংখ্যা বৃদ্ধি ও ভিত মজবুতকরণ।
৬. অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য রাষ্টী্রয় উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসাবে গৃহীত বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়ন ও সামাজিক অবকাঠামো গঠনের উদ্যোগে অংশগ্রহণ।
৭. অধিক লাভজনক হওয়া সত্ত্বেও শরীয়া ও রাষ্ট্রীয় আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ ও ক্ষতিকর খাতে বিনিয়োগ না করা।
৮. সামাজিক কল্যাণমূলক খাতে লাভ কম হলেও বিনিয়োগ উৎসাহিত করা।
৯. সরাসরি টাকা না দিয়ে পণ্য ক্রয় বিক্রয় পদ্ধতি এবং লাভলোকসান অংশীদারী ভিত্তিতে বিনিয়োগ করে প্রকৃত ব্যবসা-বাণিজ্যকে উৎসাহিত করা।

ইসলামী ব্যাংকগুলো কি প্রতারণা করছে?

ইসলাম বিদ্বেষী এবং পুঁজিবাদী ও নব্য সমাজবাদী (যারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে নিজেদেরকে পুঁজিবাদীদের সাথে একত্র করে ফেলেছে) তথাকথিত অর্থনীতিবিদগণ যারা কিছুটা না বুঝে, অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবে এবং ইসলামী ব্যাংকগুলোর সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে ইসলামী ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
শেষ নবী মুহাম্মদ (সঃ) এর নবুওত প্রাপ্তির পর ইহুদীগণ ঠিকই বুঝতে পেরেছিলো যে, ইনিই তাওরাত ও ইঞ্জিলে প্রতিশ্রুত সেই নবী। কিন্তু নিজেদের চিরাচরিত বিদ্বেষ ও ক্ষমতা খর্ব হওয়ার আশংকায় বিরোধিতা করেছে।
বর্তমানে তথাকথিত অর্থনীতিবিদগণও একই পথ অনুসরণ করছে। ইসলামী ব্যাংকের সাফল্যের ফলে নিজেদের অস্তিত্ব যখন হুমকির মুখে তখন সন্তান বাঁচানোর অপকৌশল হিসেবে তারা নতুন করে বলা শুরু করেছে যে, ইসলামী ব্যাংকগুলো প্রতারণা করছে। আর এ কাজের দোসর হয়েছে তথাকথিত কিছু ভাড়াটে অর্থনীতিবিদ আর বলির পাঁঠা হিসেবে ব্যবহার করছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে।
যেখানে, ইসলামী ব্যাংকগুলো জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে, আমদানী, রপ্তানী ও বৈদেশীক রেমিটেন্সসহ বিশ্বব্যাপী সুনামের সাথে কাজ করছে, কৃষি, শিল্প ও ব্যবসা সহ হাজার মিলিয়ন টাকার ব্যবসা পরিচালনা করছে, সরকারী রাজস্বের অন্যতম উৎস হিসেবে কাজ করছে, জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে, সেক্ষেত্রে প্রতারণার অভিযোগ একান্তই হাস্যকর।
ব্যাংক হিসেবে প্রতারণা করলে বাংলাদেশ ব্যাংক লাইসেন্স বাতিল করত কিংবা শরীয়ার নীতিমালার সাথে প্রতারণা করলে দেশের লক্ষ লক্ষ আলেম তাদের বিরোধিতা করত। কিছুই যখন হচ্ছেনা, তখন স্বাভাবিকভাবেই বুঝা যাচ্ছে, ইসলামী ব্যাংকগুলো তাদের ব্যাংক কোম্পানী আইন, সরকারী আইন, বাংলাদেশ ব্যাংক বিধিমালা ও ইসলামী শরীয়ার নীতিমালা সবই সঠিকভাবে মেনে চলছে। শামীম আফজল কিংবা আবুল বারাকাতদের এসব প্রচারণা শুধু নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এবং চিরাচরিত ইসলাম বিদ্বেষ বা ইহুদী লবির প্রদত্ত ডলারকে বৈধ করার জন্য এসব কথা বলা- যা বাস্তবে মিথ্যা। আর এসব মিথ্যা বক্তব্য দিয়ে তারাই জাতির সাথে প্রতারণা করছে।

No comments:

Post a Comment